স্বাধীনতা মানে মুক্ত হয়ে জীবনযাপন করা। নিজের মতো বাঁচা, নিজের ইচ্ছেয় বাঁচা। বাঙালি নিজের মতো বাঁচতে চেয়েছিল, পাকিস্তানিদের মতো নয়। এক রাষ্ট্রের জন্ম, যে রাষ্ট্র সম্পর্কে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সেই ভূখণ্ডের মানুষ। সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ বাংলার মানুষ এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছিল- আমাদের দেশ আমরাই শাসন করতে চাই। এরই নাম স্বাধীনতা।
আজ সেই স্বাধীনতা দিবস। গত বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করেছি। ৫১ বছর আগে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনা ঘটে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের পটভূমিতে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগমুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী ৩০ লাখ শহীদকে, স্মরণ করি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও চার জাতীয় নেতাকে।
এগুলো সবই আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু একাত্তরে যা চেয়েছিলাম তার সাথে এখনকার রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিসরের বড় ব্যবধান। যে অঞ্চলে যাদের জোর বেশি, সেই অঞ্চলে তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সবচেয়ে বেশি জোর ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর। তারাই ঠিক করে দিচ্ছে মানুষের আচার-আচরণ কী হবে। তাদের মতের সঙ্গে না মিললেই তারা বের করে ফেলছে দাঁত নখ। মানুষকে ভয় দেখিয়ে, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও উদারনৈতিকদের একটা ভয়ের মধ্যে রাখাই একটা একটা প্রচলিত ধারা হয়ে উঠছে। জন্মগত ভাবে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রে যা পাওয়ার কথা সেটা পেতে গেলেও এমন অবস্থায় পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে তাতে মনে হচ্ছে যেন তাদের প্রতি দয়া করা হচ্ছে।
মানুষের রাষ্ট্রে মানুষের মর্যাদার চেয়ে বড় মর্যাদাবান হয়ে গেছে ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে থাকা রাজনৈতিক মাস্তান চক্র, জনগণের সেবক হওয়ার কথা যাদের সেই সরকারি কর্মী আর ধর্মীয় জিকির তোলা গোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছিলেন দেশকে পরাধীনতার করাল গ্রাস থেকে বের করার জন্য, তাঁরা হয়তো কল্পনাও করেননি, এমন একটা জায়গায় এসে পড়বে তাঁদের প্রিয় জন্মভূমি।
স্বাধীনতার প্রথম লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলমুক্তি। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সেটি অর্জিত হয়েছে। দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠন; যেখানে দেশের প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হবে। এত বছর পর আত্মজিজ্ঞাসা করলে দেখব স্বাধীনতার অনেক লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষাই অপূর্ণ রয়ে গেছে। কেউ অস্বীকার করবে না যে, অবকাঠামো খাতে বড় বড় নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। দেশ এখন শতভাগ বিদ্যুতায়িত। খাদ্য উৎপাদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অনেক ক্ষেত্রে দেশ অনেক বড় কাঠামো তৈরি করতে পেরেছে। বহুমুখী যমুনা সেতুর পর আমরা পদ্মা সেতুও সমাপ্তির পথে। স্বাধীনতার যে স্বপ্ন, অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুযোগ – সেখানেও সরকারের উদ্যোগ আছে, প্রচেষ্টা আছে।
কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছরে সবচেয়ে বড় কষ্টের জায়গা এই যে, রাজনীতির গতিপথটা ঠিক করা গেলো না। একটা বিভাজিত ও বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে লালন করে নির্বাচনী ব্যবস্থা, সংসদীয় গণতন্ত্র, আইনের শাসন– সব আজ বিতর্কিত। ‘যে জিতে সব তার’ – এই মন্ত্রে ক্ষমতাশালীদের দাপট সব খানেই আইনের উপরে। আর এতে করে রাজনীতির সব পরিসরেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির প্রতি প্রশ্রয়।
এমন এক সংস্কৃতি যে কথার সাথে একটুখানি না মিললেই একজন-কে কাফের আর নাস্তিক বলা হচ্ছে, কিংবা দেগে দেওয়া হচ্ছে নানান অভিধা। স্রেফ গলা আর ক্ষমতার জোরে বিরুদ্ধমতকে, উদার মতকে থামিয়ে দেওয়ার নজির এখন সমাজের স্তরে স্তরে। এত এত অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরও মানুষের নিজের মতো থাকার অধিকার বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যেভাবে খর্ব করা হচ্ছে, সেটা দেখে দেশের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা হবেই। পাকিস্তানি আমলে আমাদের রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল বৈষম্যের অবসান। কিন্তু আজ পর সেই বৈষম্য আরও বেড়েছে। কতিপয় লোকের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত। উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও জনসংখ্যার প্রায় এক–চতুর্থাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এর অর্থ হলো উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছায়নি। আমরা যদি সত্যি সত্যি একটি ন্যায় ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে।
স্বাধীনতা ইট-কাঠ-পাথর নয়, স্বাধীনতা একটা জীবন দর্শন, একটা বাঁচার ধরন। সেটার সার্বিক পুনরুজ্জীবন একান্ত দরকার। সমাজ, ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি বোধের সব স্তরেই ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণা জায়গা পায়। রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিকের গুরুত্ব সমান। সমাজের প্রয়োজনে নিয়ম সৃষ্টি করা হয়, সমাজ তার রক্ষক সৃষ্টি করে, শৃঙ্খলার নির্ণায়ক এবং পরিচালক। কিন্তু রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের সীমা কতদূর, নাগরিক সমাজের তা ঠিক করতে হয়। আজ সেই নাগরিক সমাজই নেই। যে বিরুদ্ধ মত পোষণ করছে সেও যে দেশের ভাল চায়, নানান কাজের ত্রুটিবিচ্যুতি ধরে দিয়ে তা শোধরাতে চায়, সেটা বোঝার মতো মনের প্রসারতা থাকা দরকার রাষ্ট্রের। নাগরিক সমাজ সেটা বলুক।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।