বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের যথাযথ সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কিছু কিছু দূতাবাস। বিশেষ করে বিদেশে শ্রম উইংগুলো। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারে অনেক ক্ষেত্রে এখন দূতাবাসমুখীই হন না অনেকেই।
আইএলওর ‘দ্য হোমকামিং: প্রফাইলিং দ্য রিটার্নিং মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশই কোনো সমস্যায় পড়লে স্থানীয় দূতাবাসের সহায়তা নেন না।
প্রবাসীখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের ২৫টি দেশে বাংলাদেশের ২৯টি শ্রম উইং রয়েছে। তবে এসব শ্রম উইংয়ে পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় বাংলাদেশিরা প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না। পাশাপাশি কিছু অসাধু কর্মচারী প্রবাসীদের নানাভাবে ভোগান্তিতে ফেলেন।
সম্প্রতি খোদ আমি নিজেও অশোভন ব্যবহারের শিকার হয়েছি। কিছু দিন আগে, সৌদি আরবের জেদ্দা কনস্যুলেট অফিসে আমার এক অসুস্থ আত্মীয়ের জন্য ফোন করলে একজন কর্মচারী ভালোভাবে কথা না বলে মোবাইলের লাইন কেটে দেন।
প্রবাসীদের অভিযোগ, নতুন শ্রমবাজার তৈরিতে তারা ব্যর্থ, করোনার দুর্দিনেও বিদেশে কিছু সংখ্যক দূতাবাসগুলো যথেষ্ট দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেনি। আপদে-বিপদে বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে কূটনৈতিক মিশনগুলোর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেনি। করোনা শুরু দিকে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো খাবার প্রবাসীদের মাঝে সঠিকভাবে বিতরণ করা হয়নি। সেখানেও দুর্নীতির খবর এসেছিল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
মধ্যপ্রাচ্যে বেশ কিছু প্রবাসী জানান, নিজ দেশের দূতাবাসে গিয়ে প্রবাসীরা ভোগান্তির শিকার হন। অজস্র দূর্ব্যবহারের শিকার হন রেমিট্যান্সযোদ্ধারা। দূতাবাসে গেলে ঠিকমতো সেবা পাওয়া যায় না। অনেক সময় তারা প্রবাসীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কটূক্তি করেন। তারা আমাদের মানুষ বলেই মূল্যায়ন করেন না। পাসপোর্টে সামান্য ভুল ঠিক করতে দিনের পর দিন ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। অনেক বাংলাদেশি দূতাবাসের সেবা থেকে বঞ্চিত।
বেশ কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কুয়েত দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ধরনের অশালীন আচরণের ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়েছিল। শুধু কুয়েত দূতাবাসে এই কাণ্ড! কিন্তু না মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশগুলোতে বাংলাদেশ দূতাবাসের চিত্র প্রায় একই রকম।
সম্প্রতি ওমানে ঘূর্ণিঝড় ‘শাহিনে’র তাণ্ডবে প্রবাসীসহ স্থানীয়দের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেখানে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস সাহায্যের হাত বাড়ালেও বাংলাদেশ দূতাবাসকে খুব একটা ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। তবে বাংলাদেশি বিভিন্ন সংগঠন দুর্গতদের পাশে দাঁড়ায়। অসহায় প্রবাসীদের মাঝে তাদের খাবার বিতরণ করে।
আবুল কালাম আজাদ (ছদ্মনাম)। তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রবাসীদের পাসপোর্ট করতে অনেক টাকা গুনতে হয়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কঠোর নীতি গ্রহণ ন করায় দূতাবাসের বেশকিছু কর্মচারী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা এখন দূতাবাসের মূলহোতা।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দূতাবাসের শ্রম শাখায়। শ্রম শাখার যেসব কর্মকর্তাদের অস্থায়ী বা লোকাল নিয়োগ করা হয়েছে তাদের একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে! শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়, ইউরোপ,পূর্ব এশিয়ার দূতাবাসগুলোতে একই চিত্র। দূতাবাসের বাইরে ও ভেতরের সিন্ডিকেটরা প্রথম সচিব ও রাষ্ট্রদূতদের সবসময় ম্যানেজ করে চলেন।
প্রবাসীদের বিভিন্ন দাবির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দূতাবাসের কিছু সংখ্যক অসাধু কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করা। দুর্নীতিতে আক্রান্তদের বিচার না হওয়ার কারণে প্রবাসীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে দ্বিধাবোধ করেন না। এই ধরনের রূঢ় আচরণে বৈদেশিক মিশনে একজন কর্মচারী কাজ করতে পারেন কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রবাসী বোদ্ধামহলে।
সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের উৎসাহী করতে অভিবাসী দিবসে ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার দিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, একজন প্রবাসী দেশে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, সেটার প্রমাণ স্বরূপ তিনি দূতাবাসে সব কাগজ জমা দেন। কিন্তু ওই প্রবাসীকে বাংলাদেশ দূতাবাস পুরস্কৃত করেনি। তার চেয়ে কম টাকা পাঠানো মানুষকে দূতাবাস পুরস্কৃত করেছেন।
পুরস্কার না পাওয়া ব্যক্তি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দূতাবাসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। স্ট্যাটাসে লেখেন, দূতাবাসের এমন বৈষম্য যেন দেখার কেউ নেই। মেহনতি মানুষের জীবনের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই স্বাধীনতার বিনিময়ে রাষ্ট্রদূত হয়ে আজ বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। সে কথাটি অনেকে ভুলে যান।
মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দূতাবাসে প্রবাসীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার যেন রুটিন ওয়ার্ক। অনেক দেশপ্রেমিক প্রবাসবান্ধব রাষ্ট্রদূত আছেন তারা কাজ করে যাচ্ছেন প্রবাসীদের জন্য সেটি যেমন সত্য। অনেকে বেঁচে থাকার জন্য, চাকরি করতে হবে বলে চাকরি করেন সেটিও সত্য। অনেক সময় কর্মকর্তা কর্মচারীরা সিন্ডিকেট করে রাষ্ট্রদূত বরাবর সঠিক খবর পৌঁছান না।