ভারতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন ও প্রতিমন্ত্রী অশ্বিনী চৌবে পদত্যাগ করেছেন। আরও অনেকেই পদত্যাগ করেছেন, তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগই বেশি আলোচনায়। গত ৩ জুলাই আমাদের জাতীয় সংসদেও করোনা ভাইরাস নিয়স্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পদত্যাগ দাবি করেছেন কয়েকজন সাংসদ। পদত্যাগেই সমাধান নেই – এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে, বিশেষ করে যারা দায়িত্বে থাকেন বা যারা সেইসব মানুষকে দায়িত্বে রাখেন তাদের ভেতর। কিন্তু সমাধান নিশ্চয়ই দায়িত্ব পালনে এবং সুব্যবস্থাপনায়। করোনা ভাইরাস শনাক্তের দেড় বছরেও কাঙ্ক্ষিত সেই পারফরমেন্স বা ভিজিবিলিটি নেই আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের। গত মঙ্গলবার আমাদের এই আলোচিত মন্ত্রণালয় হঠাৎ করে সারাদেশের সরকারি ডাক্তারদের বদলির আদেশ ঘোষণা করে। এদের মধ্যে আছেন সাত মাস আগে মারা যাওয়া চিকিৎসক, অবসরে যাওয়া চিকিৎসকও। এমনকি দাঁতের ডাক্তারকেও নাকি পদায়ন করা হয়েছে কোভিড ইউনিটে। তুমুল আলোচনা সমালোচনার মুখে এই আদেশ বাতিল করে মন্ত্রণালয়। এই কাজকে কিভাবে মূল্যায়ন করব আমরা? খুব ইতিবাচকভাবে দেখলে বলতে হবে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় করোনা ব্যবস্থাপনায় এতই সিরিয়াস যে, তারা ভেবে দেখেছে – মৃতেরও সামর্থ্য আছে, মৃত চিকিৎসককে দিয়েও কাজ করিয়ে নিতে চায়, অবসরে যাওয়া ব্যক্তিকেও ছাড় দেওয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পুরো করোনা পরিস্থিতি তথা স্বাস্থ্যচিত্রে যে এই মন্ত্রণালয়ের কোন নজর নেই তার প্রমাণ এই বদলি আদেশ। প্রতিদিন মৃত্যু আর সংক্রমণের ধাক্কা ভেঙে দিচ্ছে সব রেকর্ড। দিনে মৃত্যু ২০০ অতিক্রম করেছে এবং রোগী শনাক্তের হার ৩১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। প্রথম ধাক্কার সময় সংক্রমণ কেন্দ্রীভূত ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামে। এখন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সারাদেশে। এই হারে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে দেশের করোনা পরিস্থিতি অচিরেই হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এখনও যে হাতের ভেতরেই সেটাও কি বলা যাচ্ছে?
পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে। করোনা ভাইরাস প্রবল ভাবে সক্রিয় হয়েছে দেশের বিস্তীর্ণ প্রান্তে। সংক্রমণ যখন প্রবল শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের এই বদলি ছেলেখেলা আমাদের যতটা না চিন্তিত করে, তার চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ করে। করোনা রোগীর চিকিৎসার প্রশ্নে ন্যূনতম যে প্রোটোকলগুলি— যেমন অক্সিজেন, শয্যা, অক্সিজেনযুক্ত শয্যা ইত্যাদি রয়েছে কিনা, নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চিকিৎসা দেওয়া যাবে কিনা, এমন পর্যালোচনা কতটুকু করতে পেরেছে মন্ত্রণালয় গত দেড় বছরে, তার একটা নিরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে, সরকারের ভাবমূর্তির স্বার্থে, এদেশের মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের সু-ব্যবহারের স্বার্থে এই নিরীক্ষা হওয়া দরকার। দরকার যার যতটুকু করার ছিল তা তারা করেছে কিনা সেটা জানতে। মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা, উদাসীনতা দেখে দেখে সংবেদনশীল মানুষ এখন ক্লান্ত। সংক্রমণের হার কমাতে বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া হয়েছে ব্যাপক হারে টিকা প্রদানে। এর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু টিকা প্রাপ্তি সহজ কাজ নয় এবং সে চেষ্টা প্রধানমন্ত্রী করছেন। প্রধানমন্ত্রী এক বছর আগে নির্দেশনাও দিয়েছিলেন যে, দেশের সব সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ থাকবে, পর্যাপ্ত অক্সিজেন থাকবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থও বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু কেন ৫২ শতাংশ সরকারি হাসপাতালে এখনও আইসিইউ নেই, ৩৭ জেলায় সরকারি হাসপাতালে কেন অক্সিজেন নেই এসব প্রশ্নের জবাব মন্ত্রণালয় না দিলেও তাদের গাফিলতি ও অদক্ষতা লুকোনো থাকে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সংক্রমণ এবং মৃত্যুর যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, সেটি আসলে তিন সপ্তাহ আগের অবস্থার বর্তমান পরিণতি। লকডাউন শুরুর হওয়ার আগে সপ্তাহখানেক ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষ যেভাবে গাদাগাদি করে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে গেছে, তার প্রভাব কী হতে পারে সেটি দেখার জন্য আরও তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এই বিপদ অপ্রত্যাশিত ছিল না। করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আসবার সতর্কবার্তা পূর্বেই মিলেছিল। তৎসত্ত্বেও মন্ত্রণালয় আগাম প্রস্তুতির কাজ উপেক্ষা করেছে। বরং এক প্রকার আত্মপ্রসাদের প্রকাশ দেখেছিলাম আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ অনেকের কথায়। বিপদ আসন্ন বুঝে আগাম প্রতিকারের ব্যবস্থা করবার পথটি উপেক্ষা করার পরিণতি ভোগ করছি এখন আমরা। আমরা এখনও জানি না এখনকার পরিস্থিতি ও সামনের দিনগুলোতে কোভিড মোকাবিলায় মন্ত্রণালয়ের সম্ভাব্য কর্মসূচি কী। জানিনা আমরা নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছি কিনা। শুধু দেখছি কঠোর কোমল বিধিনিষেধ যাকে গণমাধ্যম নাম দিয়েছে লকডাউন। অতিমারি সারা দেশে হাহাকার ফেলেছে। সেনাবাহিনী নামিয়েও বিধিনিষেধও পুরোপুরি মানানো সম্ভব হচ্ছে না। সংক্রমণ কতটা কমবে সেটি নির্ভর করবে লকডাউনের সফলতার উপরে। কিন্তু সেটি বেশিদিন চালানো বাস্তব সম্মত নয়। করোনা পরীক্ষা, বিশেষ করে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার অনুপাত বাড়ানো, মাস্ক পরাসহ কোভিড সতর্কতাবিধি মেনে চলার উপরে জোর দেওয়ার বিকল্প নেই। মাস্ক না-পরলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আর্থিক জরিমানা ও জেলে ভরার মতো কড়া পদক্ষেপ করার বিকল্প আর দেখছি না আমরা।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।