রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:২৫ পূর্বাহ্ন
সদ্যপ্রাপ্ত খবর :
অটিস্টিক শিশুদের আবাসন ও কর্মসংস্থান করবে সরকার   ||   নারীর প্রতি যৌন ও পারিবারিক সহিংসতা ক্রমাগতই বাড়ছে   ||   শান্তিগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের নব-নির্বাচিত সভাপতি হলেন মৃত্যুঞ্জয়ী ছাত্রনেতা ছদরুল ইসলাম  ||

ইলিশের চড়া দামে চুপসে গেল মন

সম্পাদকীয় ডেস্ক / ৬১৫ বার পঠিত:
আপডেট সময় : শুক্রবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১
ইলিশের চড়া দামে চুপসে গেল মন

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

ইলিশ প্রিয় মানুষের কথা ভাবছি। যারা ইলিশের মৌসুম এলে খুশি হয়ে মাছবাজারের খোঁজ নেন। ইলিশভক্ত মানুষের সগোত্রীয়রাও বর্ষার শেষের এই সময়টাতে এক অপরের সাথে এ বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করে থাকেন। বাজারে ইলিশের দাম কমলে সে খবর দ্রুত চাউর হয়ে যায় তাদের মধ্যে। কেনা হয় অনেকগুলো। ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রেখে নিজে খাওয়া হয়, নিকটজনদেরকে উপহার দেয়া হয়। কিন্তু এবছর কোন ভাল খবর হচ্ছে না। ভাল খবরের প্রধান প্রতিপাদ্য হলো ইলিশ ধরা পরার পরিমাণ বেশি, বাজারে মাছের আমদানী বেশি এবং হঠাৎ দাম কমে যাওয়া। কিন্তু নাহ্। এসবের কোনটাই এবারে হচ্ছে না বিশেষ কারণে। একজন ইলিশ ভোজন রসিক করোনার ভীতি উপেক্ষা করে বড়বাজারে গিয়ে প্রতিদিন একবার করে ঢুঁ মারেন মাছের গলিতে। ডালি ডালি বরফের মধ্যে সাজানো-ঢেকে রাখা বড় বড় ইলিশ দেখে তার কিনতে ইচ্ছে করে। অনেক জায়গার, অনেক নদীর, নানা আকৃতির ইলিশ মাছে ডালি সাজানো। কেউ হাঁকেন এটা পদ্মার ইলিশ, কেউ মেঘনার, কেউ পাথরঘাটার, কেউ চাঁদপুরের, কেউবা সাগরের ইলিশ বলে চিৎকার করে মনোযোগ আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন ক্রেতাদের।

কিন্তু দূর থেকে অন্য ক্রেতাদের মধ্যে দোকানির দাম নিয়ে দর কষাকষি শুনে তিনি পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যান। সাত আটশ’ গ্রাম সাইজের ইলিশের দাম হাজার টাকা কেজি এবং এক কেজি সাইজের একটি ইলিশের দাম ১৬০০ টাকা চাওয়া হচ্ছে। আমাদের মর্যাদার প্রতীক জাতীয় মাছের এত দাম কেন হবে? অনেকদিন এভাবে যাচাই করেও দাম বেশি জানতে পেরে এখন আর মাছের বাজারের গলিতে পা মাড়াতে তার মন চায় না। ইলিশের ভরা মৌসুমে কেন এমন হচ্ছে? এবছর ফেরিওয়ালারা একদিনও ইলিশ মাছ নিয়ে বাড়ির সামনে এসে হাঁকডাক দিল না। সাধারণ মাছওয়ালারা জানালো ভিন্ন কথা। মাছ বিক্রেতা একব্বার আলী (ছদ্মনাম) তাদের মধ্যে বেশি তথ্য দিতে জানে। সে জানালো, এবছর ইলিশ কমদামে পাবেন না স্যার। নদী-সমুদ্র থেকে ধরার সাথে সাথেই ইলিশ পাচার হয়ে যায় বিদেশে! এই পাচার প্রতিবছর হয়। কিন্তু এবছর খুব বেশি চাহিদা। অনেক বেশি দাম দিয়ে হলেও পাচারকারীরা খুব তৎপর। এজন্য ঘাটে ঘাটে ঘুষ আগেই দেয়া আছে। এবার তাই কাউকে ধরা হচ্ছে না।

ইলিশের বেলাতেও ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপকতার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল মনি সাহেবের। চোরাচালানী দেশটারে খায়া ফেলাইছে স্যার। করোনাও ঢুকেছে চোরাচালানী পণ্যের মাধ্যমে। ডেঙ্গুও ছড়াচ্ছে চোরাচালানীদের সংক্রমিত দেহ এবং বাস, ট্রাক. ট্রেন থেকে। দেশে এখন এত চুরি জালিয়াতি চলছে। ই-কমার্সের জালিয়াতিতে বেকার যুবকরা আরও বেকার হয়ে সর্বস্বান্ত গেল স্যার। একবার মারলো ডেসটিনি না কি যেন! এরপর মারলো এক এনজিও। এখন মারছে ইভ্যালি, ধামাকা নাকি এইরকম নব্য লুটেরা- রা। আমাদের গরীবের মরণ। আমার মাছের ব্যবসা এবার হলো না স্যার। সবাই কমদামে ইলিশ কিনতে চায়। আগের মত কাউকেই এবার ইলিশ দিতে পারছিনা স্যার। দেশীয় ব্যবসায়ীরা ইলিশ কিনে সংরক্ষণ করছেন হোটেল ও পহেলা বৈশাখের জন্য। সেগুলো বড় লোকেরা কিনে খাবে। স্বল্পআয়ের মানুষ খেতে পারবেনা। নিম্ন আয়ের দরিদ্ররা ইলিশের আকালের খবর শুনে ঠোঁট-মুখ চেটে ইলিশের স্বাদ সিলভার কার্প ও শরপুঁটি দিয়ে মিটাবে স্যার।

আমাদের এলাকায় কয়েকজন আসে নিয়মিত মাছ বিক্রি করতে। কেউ এবার ইলিশ বেঁচতে আসছে না। সবার মুখে একই কথা। বাজারে ইলিশের সরবরাহ নেই। করোনার ভয়ে গত প্রায় দু’বছর কাঁচা বাজারে যাওয়া হয়নি আমার। বাড়িতেই সবজি, মুরগী, মাছ সবকিছু নিয়ে আসে। ওরা নিজেরাই মাপজোক করে কেটে ধুয়ে দাম নিয়ে চলে যায়। ওরা অতি বিশ্বাসী আমাদের কাছে। আমাদের মহল্লার প্রায় সবাই করোনাকালে আমার মত ওদের সেবার উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। মজা করে বললাম, পুকুরে ইলিশের চাষ হচ্ছে। গবেষণা করে পুকুরে ইলিশের চাষ হলে আর এত দাম দিয়ে কিনতে হবে না। পাচারের জন্য আক্ষেপ থাকবে না। চোরাচালানকারী ইলিশ দস্যুদের দিন ফুরিয়ে যাবে। একথা শুনে সে একগাল হেসে দিল। পুকুরে হয়তো বড় বড় ইলিশ জন্ম নেবে। ফিড খাবে ব্রয়লার মুরগী বা মাগুর মাছের মত পেট ভরে। তখন পুকুরের ইলিশের কি সেই স্বাদ থাকবে স্যার? আর ইলিশের আসল স্বাদ-গন্ধ না পেলে মানুষ সে ইলিশ কিনতে যাবে কেন?

এখন কি কেউ পাঙ্গাস, পাবদা, মাগুরের স্বাদ পায়? চাষ করা রুই, কাতলা, কালবাউস কোনটারই স্বাদ নেই। দামও খুব কম। বাজারে এত বড় বড় চাষ করা দেশী রুই, কাতলা, পাঙ্গাস মাছ থাকলেও মানুষ নদীর ইলিশ কেনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে কেন স্যার বলতে পারবেন? আমি ওর একটানা বক্তব্য শুনে চুপ করে থাকলাম। মাছ বিক্রি কররেও সে নদীর প্রাকৃতিক মাছ সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখে। এমন কি ইলিশ মাছের চেহারা দেখেও সে বলে দিতে পারে সেটা কোন নদীর না সমুদ্রের এবং স্বাদ কেমন! তাজা এবং স্বাদ হবে এমন মাছ পেলেই সে আমার বাসায় দিয়ে যায়। যার দাম একটু বেশি নেয় সে।

একবার আমার এক আত্মীয় গোটা পরিবার নিয়ে আমাদের বাসায় বেড়াতে এলো। ওর বেইলি রোডে বিখ্যাত খাবারের দোকান আছে। মজাদার নানা খাবার সেখানে হরদম বিক্রি হয়। সব মাছের স্বাদ সম্পর্কে তার অগাধ অভিজ্ঞতা। তবু বললাম, আজ তোমরা আমাদের বাসায় খেয়ে যাও। নদীর ইলিশ দিয়ে সাদা ভাত খাবে শুধু। ওরা রাজি হয়ে গেল। খেতে খেতে আরো মাছ আছে কি-না জানতে চাইলো। ফ্রিজে কাঁচা মাছ আছে কি-না দেখতে চাইলো। আমি কেন জিজ্ঞেস করাতে বললো- আমি এত ইলিশ কিনি কিন্তু এত বেশি স্বাদের ইলিশ মাছ তো কখনো খেয়েছি বলে মনে হয় না। কোথায় পেলেন আপনি এই ইলিশ মাছ?

আমি বললাম, সাগরের মাছ আমি কিনি না। মাছটা কোন নদীর মাছ সেটাও আমার কাছে মুখ্য বিষয় নয়। বিষয়টা স্বাদের উপর নির্ভরশীল। আমি মাছওয়ালাকে বলেছি- স্বাদের মাছ দেখলেই আমার জন্য নিয়ে আসবে। সেটা বেশি দামী হলেও। আসলে মাছ বিক্রেতারা সবাই কম-বেশি স্বাদের ইলিশ মাছ চিনে। পরিচিত মানুষকে তারা ভালটা সাপ্লাই দেয়। তবে মাঝে মধ্যে দু’একটা পচাও থাকে। সেটা নাকি ওদের ব্যবসায়িক নিয়ম। সেজন্য পরে ক্ষমা চায়। তবে স্বাদ-গন্ধের ব্যাপারে ওর বিক্রি করা ইলিশের জুড়ি নেই। আমার আত্মীয় ওর ফোন নম্বরটা নিল নিজের ব্যবসার সুনাম বাড়ানোর জন্য। তবে সে তার সাথে যোগাযোগ করেছে কি-না আর জানা হয়নি।

আমাদের নদী-সাগরের স্বাদযুক্ত বড় ইলিশ ধরার আগেই যুক্তি করে বিদেশে পাচার করার জন্য। সীমান্তে গরু পার করতে গিয়ে আমাদের লোকেরা গুলিতে প্রাণ হারালেও আমাদের নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ড কখনও কোন পাচারকারীকে গুলি করে মেরেছে কি-না জানি না। কারণ, তাদের মধ্যে অসাধুরা ইলিশ পাচারের সুবিধা দিতে আগাম যোগাযোগ করে রাখে। অথচ, আগাম চুক্তি করে টিকার জন্য অগ্রিম টাকা পরিশোধ করে আমরা করাল মত টিকা না পেয়ে মারা যাই। কিন্তু ইলিশ, চামড়া, পাট, প্রভৃতি পাচার করে দিই ঘুষের বিনিময়ে। এ কোন ধরনের ঘৃণ্য মানসিকতা আমাদের মধ্যে কাজ করে?

দুর্নীতি আমাদের ক্রনিক ব্যাপার। আমাদের অস্থি-মজ্জায় ঘুষ-দুর্নীতি, জালিয়াতি মিশে গেছে কার কারণে? অতিরিক্ত মাদক সেবন করে কক্সবাজার সি-বিচে গত ১৮.০৯.২০২১ দু’জন যুবক অকালে প্রাণ হারালো। নেতারা, অনেক বড় বড় চাকুরীজীবীরা যে পরিমাণ বৈধ আয় করি তার চেয়ে দশগুণ ব্যয় করি। এত অবৈধ টাকা কোন ভূতে যোগান দেয়? আমরা একদিকে ঘুষ নিয়ে সংসার চালাই, অন্যদিকে কেউ কেউ নিজেকে সাধু মনে করে প্রেস ব্রিফিং দিয়ে মানুষকে সৎ হবার পরামর্শের বাণী শোনাই।

এমন অবস্থা হলে কেউ দশ হাজার টাকা কেজি দর হলেও ইলিশ কিনে অসুরের মত ভক্ষণ করবে আর কেউ দাম শুনে মাছবাজারে গিয়েও মন খারাপ করে এক হালি শরপুঁটি বা একটি সিলভার কার্প কিনে ইলিশের সাজানো ডালির দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস না পেয়ে ভিন্ন গলিপথে বাসার দিকে হাঁটতে থাকবে।

এর মূল কারণ দেশ থেকে ঘুষ-দুর্নীতি ও অসততা যতদিন উৎপাটিত হবে না ততদিন নদী সমুদ্র থেকেই ইলিশ পাচার ও উধাও হয়ে যেতে থাকবে। অসৎ মানুষগুলোর লাগামহীন ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা শুধু ডাবল-ট্রিপল জিরো পেয়ে উপহাস করতে থাকবে। আর ইলিশের ভরা মৌসুমেও আমরা চড়া দাম শুনে মন খারাপ করে ঠোঁট-মুখ চেটে বিষণ্ণ মনে পাঙ্গাস-পুঁটি দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমাতে যাব বৈ-কি?

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
fakrul@ru.ac.bd


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই রকম আরো সংবাদ